যে ৭ শ্রেণীর মানুষ, যারা কেয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে

সূরা হজ্জের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক কেয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা বর্ণনা তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে,


ياَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٍ عَظِيمٌ يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا اَرْضَعَتْ وَ تَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَ تَرَى النَّاسَ سُكرى وَ مَا هُمْ بِسُكْرَى وَ لَكِنَّ عَذَابَ اللهِ شَدِيدٌ.


অর্থাৎ, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। নিশ্চয়ই কেয়ামতের ভয়াবহতা এক প্রচণ্ড বিষয়। সেদিন এমন অবস্থা হবে যে, কোন দুধ দেয়া মা, যার কাছে দুধের সন্তান আছে সে তার দুধের সন্তানের কথা ভুলে যাবে। গর্ভবর্তী মহিলার গর্ভপাত হয়ে যাবে। মানুষকে মনে হবে হুশ হারা, অথচ তারা বেহুশ নয়।

প্রতিটি মাখলুককেই কাল কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কিয়ামতের ময়দানের সেই কঠিন মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন মানবমণ্ডলীকে লাল শ্বেত মিশ্রিত এমন এক সমতল ভূমিতে একত্র করা হবে, যেন তা পরিচ্ছন্ন আটার রুটির মতো। ওই জমিনে কারো (বাড়িঘরের বা অন্য কিছুর) চিহ্ন থাকবে না। (বুখারি ও মুসলিম)
কিয়ামতের দিনটি প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকবে।


রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, বিচার দিবসে সূর্যকে মানুষের কাছে আনা হবে, তা হবে তাদের থেকে এক ফরসাখ (তিন মাইল) দূরে। ব্যক্তির আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে অবস্থান করবে। কারো ঘাম হবে টাখনুসমান, কারো হাঁটুসমান, কারো কোমরসমান, কারো মুখসমান। (মিশকাত, পৃষ্ঠা : ৪৮৩)

সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে মহান আল্লাহ কিছু মানুষকে তাঁর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যেদিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৬০)

এখানে কেয়ামতের ময়দানের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐ ভয়াবহ দিনে সাত ধরনের মানুষ এমন থাকবে, যাদেরকে আল্লাহ পাক তাঁর আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। কেয়ামতের দিন এটা হবে আল্লাহর বিশেষ রহমত। আল্লাহ পাক তাদের প্রতি খাস রহমত দান করবেন। যারা সেদিন আরশের নীচে ছায়া পেল তারা আল্লাহ পাকের খাস রহমত প্রাপ্ত হল। এই সাত প্রকারের লোকের মধ্যে
প্রথম প্রকারের লোক হল-


الْإِمَامُ الْعَادِلُ.

অর্থাৎ, ইনসাফগার শাসক।

১. ন্যায়পরায়ণ শাসক : মহান আল্লাহ এই শ্রেণির লোকদের ভীষণ ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন। (সুরা হুজরাত, আয়াত : ৯)


যাদের হাতে যতটুকু শাসন ক্ষমতা আছে, সে যদি সেই ক্ষমতার অপব্যবহার না করে, বরং ইনসাফের সাথে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তাহলে আল্লাহ পাক তাকে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। আল্লাহ পাক হলেন ইনসাফগার, তাঁর আরশ বা সিংহাসন হল ইনসাফের প্রতীক, তাই ইনসাফগারদেরকে তিনি সেই ইনসাফের প্রতীক আরশের নীচে স্থান দান করবেন।

দ্বিতীয় প্রকারের লোক হল-


وَشَابٌ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ.
অর্থাৎ, যারা যৌবনে আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৎপর হয়।

২ যে যুবকের জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের
ইবাদতের মধ্যে : যৌবন মহান আল্লাহর অনেক বড় নিয়ামত।
এই নিয়ামতকে যারা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে,
তারাই সফল হয়। সাধারণত যৌবন মানুষকে
বেপরোয়া বানিয়ে দেয়, যৌবনের তাড়নায় কেউ কেউ
ডুবে যায় পাপের সাগরে। এই যৌবনকে যারা
আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে, তারা কঠিন কিয়ামতের
দিন আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে।

আমরা তো বয়স হলে খুব আল্লাহকে স্মরণ করি, যৌবন বয়সে আল্লাহকে তেমন স্মরণ করি না। যৌবনের সময় মনে করি, এই বয়সটা তো ফূর্তিফার্তির বয়স, এখন কি ইবাদতের বয়স হয়েছে? অনেক গার্জিয়ানও এমন আছে, যারা তাদের ছেলে-মেয়েরা অল্প বয়সে ইবাদত-বন্দেগী শুরু মনে করেন বা মুখে বলেও থাকেন যে, এখন কি এসবের বয়স হয়েছে? এখন তো লেখাপ বয়স। তাদের ভাবখানা এমন যে, ইবাদত-বন্দেগী করার বয়স হল যখন বৃদ্ধ হবে, যখন কো হয়ে আসবে, যখন দুনিয়ার কোন কিছু করার দৈহিক ক্ষমতা আর থাকবে না তখন। তারা উল্টো মুখে বসে আছে, তারা যৌবনে ইবাদতকে পছন্দ করে না, অথচ আল্লাহ, আল্লাহর রসূল যৌবন বয়সে ইবাদতকেই বেশী পছন্দ করেন। বুড়া হয়ে গেলে কমর যখন বাকা হয়ে যায়, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর, সোজা হয়ে বসার, সঠিক ভাবে রুকু করার যখন কোন ক্ষমতা থাকেনা, তখন ইবাদত করার কী মূল্য? যারা যৌবনের উচ্ছলতাকে উপেক্ষা করে ইবাদত করছে, যৌবনের পাপের চাহিদাকে উপেক্ষা করে ইবাদত করছে, তাদের ইবাদত আর যাদের এক পা কবরে চলে গেছে তাদের ইবাদত কখনই সমান হতে পারে না। যৌবনে ইবাদতের মূল্য অনেক বেশী। কারণ তাদের ইবাদত করতে নফসের সাথে মুজাহাদা বেশী করতে হয়। তাই যারা যৌবনে ইবাদতের জন্য তৎপর হয়, তারা আল্লাহ পাকের বিশেষ পছন্দের মানুষ হয়ে যায়। তাই বিশেষ পছন্দের মানুষ হিসেবে আল্লাহ পাক তাদেরকে আরশের নীচে ছাঁয়া দান করবেন। এই হল দ্বিতীয় প্রকারের লোক, যাদেরকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর আরশের
নীচে ছায়া দান করবেন।

 

তৃতীয় প্রকারের লোক হল-

وَرَجُل قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ.
অর্থাৎ, যার অন্তর মসজিদের সাথে লাগানো থাকে।

৩. যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে : আল্লামা
নববী (রহ.) বলেন, মসজিদের সঙ্গে অন্তরের
সম্পৃক্ততা দ্বারা উদ্দেশ্য, মসজিদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ গুরুত্বসহকারে মসজিদে পড়া।
সার্বক্ষণিক মসজিদে বসে থাকা নয়। (উমদাতুল কারি
: ৫/২৬১)

যে ব্যক্তি নামায পড়ার পর মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় কিন্তু আবার নামাযের জন্য
মসজিদের আসার কথা তার মনের মধ্যে জাগ্রত থাকে। এ লোকের অবস্থা এমন যে, মসজিদ থেকে যেন বের হতে তার মনে চায় না কিন্তু প্রয়োজনের তাগীদে তাকে বের হতে হয়েছে। সংসার ধর্ম করা, সমাজ- সমাজিকতার কাজ করা, আয়-উপার্জনের কাজ করা এগুলো তার করতে হয়, এই প্রয়োজনে সে বের হয়েছে, কিন্তু আসলে তার মন লাগানো রয়েছে মসজিদের সাথে। আবার যখন সে মসজিদে ফিরে আসে, তখন সে এতমিনান বা প্রশান্তি বোধ করে। আবার প্রয়োজনে বের হয় কিন্তু বের হতে তার মনে চায় না। আবার ফিরে আসলে তার এতমিনান হয়। অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারের সাথে তার মহব্বতের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাহলে এরূপ লোকও আল্লাহর খাস লোক, তারা খাঁটি মু'মিন।
তাই আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর আরশের নীচে তাদেরকে ছায়া দান করবেন।

চতুর্থ প্রকারের লোক হল-


وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ.
অর্থাৎ, ঐ দুই জন লোক, যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবাসে। 
৪. ওই দুই ব্যক্তি, যারা পরস্পরকে ভালোবাসে
আল্লাহর জন্য : (তারা একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং
পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বলবেন, সেসব মানুষ কোথায়, যারা আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসত। আজ আমি তাদের আমার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেব। আজকের দিনটা এমনই যে আজ আমার ছায়া ছাড়া কোথাও কোনো ছায়া নেই। (মুআত্তায়ে মালিক, হাদিস : ১৭১৮)

আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ভালবাসা কিংবা আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ভালবাসা বর্জন- এর একটা দৃষ্টান্ত হল হযরত আলী (রা.)-এর একটা ঘটনা। একদিন এক ইয়াহুদী হযরত আলী (রা.)-এর সামনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালি দিল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেয়া জঘন্য ধরনের বে-আদবী এবং জঘন্ন ধরনের কুফরী। হযরত আলী (রা.) বাহাদূর মানুষ। তার সামনে এরকম অবস্থা ঘটছে। তিনি সাথে সাথে লোকটাকে ধরে আছাড় দিয়ে
ফেলে দিলেন। তার বুকের উপরে চড়ে বসলেন এবং তলোয়ার নিয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কারণ কাফের মুরতাদকে হত্যাই করে দিতে হয়। লোকটা নীচেয় থেকে হযরত আলী (রা.)-এর মুখে থুথু মেরে দিল। থুথু মারার সাথে সাথে হযরত আলী (রা.) লোকটাকে ছেড়ে দিলেন,
আর তাকে হত্যা করলেন না। তখন সাথী সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন যে, আপনি তার বুকের উপরে চড়ে বসেছেন, হাতে তলোয়ার, তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন আর এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে দিলেন! থুথু মেরেছে বলে তো আরও বেশী রাগ হয়ে তাড়াতাড়ী তাকে হত্যা করে দেয়ার কথা। হযরত আলী (রা.) বললেন যে, আগে তার প্রতি আমার যে রাগ হয়েছিল সেটা ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে রাগ যে, সে আল্লাহর রসূলকে গালি দিয়েছে, আমি মুসলমান হয়ে কী করে বরদাশত করতে পারি। এই রাগটা ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে রাগ। কিন্তু যখনই সে আমার মুখে থুথু দিয়েছে, তখন আমার যে রাগ এসেছে সেটা হল আমার ব্যক্তিগত রাগ। অতএব এ অবস্থায় যদি তাকে হত্যা করি তাহলে সেটা হবে আমার ব্যক্তিগত রাগে হত্যা করা। এটা হবে আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা। বন্ধুত্ব ও শত্রুতা সব আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হওয়া চাই। আগে ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে, আর এবার হল ব্যক্তিগত শত্রুতা, একারণে তাকে ছেড়ে দিয়েছি। দেখা গেল মনের উপরে সাহাবায়ে কেরামের কতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। এটাই হল আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা ও আল্লাহর ওয়াস্তে শত্রুতা।

পঞ্চম প্রকারের লোক হল-


ورجل دَعَتْهُ ذَاتُ مُنْصَبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ الله.
৫. অর্থাৎ, ঐ ব্যক্তি, যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী সৌন্দর্যের অধিকারীণী নারী যেনার দিকে আহবান করে আর সে এই বলে যেনা থেকে বিরত থাকে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। এখানে বোঝানো হয়েছে- ঐ ব্যক্তিও আরশের ছায়া পাবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে তার প্রেমের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। দুনিয়ার কোন সুন্দরী এবং বংশীয়া নারীও যদি তাকে অপকর্মে আহবান করে, তাহলে সে আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত থাকে। এর অর্থ হল সে তার চেতনাকে, তার যৌন উচ্ছলতাকে আল্লাহর ভয়ে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে।  সেই সব মুত্তাকিকে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়াতলে
আশ্রয় দেবেন।

ষষ্ট প্রকারের লোক হল-

وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ اِحْفَاءٌ حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ.
৬ অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয় করে এমন গোনপভাবে যে, তার ডান হাত যা ব্যয় করে তার বাম
হাত তা জানতে পারে না।

যে এমন গোপনে দান করে যে তার
ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না। এর দ্বারা উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান- সদকাকারীকে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন।

সপ্তম প্রকারের লোক হল-

وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًّا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ.
৭ অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নির্জনে বসে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার চোখ অশ্রু ঝরাতে থাকে।
যে ব্যাক্তি মনের আবেগ মিশিয়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে আর মনে থাকে আল্লাহর চিন্তা-চেতনা, মনে থাকে পরকালের চিন্তা-চেতনা, মনে থাকে জাহান্নামের ভয়, আযাে এই ভয়ে সে কাঁদতে থাকে, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে, উপরোক্ত গুণগুলো একজন খাঁটি মুত্তাকির মধ্যেই
পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।




 

Madrasa Jobs

New Things Will Always
Update Regularly

Madrasa Jobs